অসমের পথে প্রান্তরে
অজয় মজুমদার
কয়েকজনের চেষ্টায় আবার অসম যাত্রা৷ এই ট্যুর তালিকায় সম্মিলনীর অনেক সদস্যই ছিল, কিন্ত শেষ পর্যন্ত তারা কেউই উৎসাহিত হলো না৷ কারন এই ট্যুরটি ছিল ফাইভ সিস্টার অর্থাৎ অসম , মেঘালয় ,নাগাল্যান্ড , মিজোরাম, ও মনিপুর৷ এ বিষয়ে সবাই উৎসাহিত ছিল৷ ২০২১ সালে কোভিড-১৯ সব বিন্দু পরিকল্পনা ভেস্তে দিল৷ সেটা অনেক দিনের ট্যুর ছিল৷
বনগাঁ থেকে ন'টা পঞ্চাশে মাঝেরহাট যাওয়ার ট্রেনে বিবিডি- বাগ নামলাম৷ আমরা দলে নয় জন। গঙ্গা পার হলাম ৷ ওপারেই হাওড়া স্টেশন ৷আমরা লাগেজ ট্রলি নিয়ে এগিয়ে গেলাম ৷ ১০ নম্বর প্ল্যাটফর্মের সামনে ওয়েটিং প্লেসে বসে বিশ্রাম করতে থাকলাম ৷বেলা ৩.৫৫ তে সরাইঘাট এক্সপ্রেসে আমরা উঠবো । হাওড়ার নানা দৃশ্য ও মানুষের ব্যস্ততা সবকিছু দেখতে থাকি ৷ অনেকেই 'জনতার আহার' থেকে খাবার খেয়ে আসে৷ আমরা সবাই কিছু কিছু খেয়ে নিলাম ৷ এমন সময় সিনিয়র প্রদীপের কন্যা মিমি কতদূর থেকে আমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে ৷ আমরা সেসব খাবার ভাগ করে খেলাম ৷এই খাবার গুলির মধ্যে আমার কাছে উল্লেখযোগ্য খাবার ছিল ধোকলা । সময় এগিয়ে এলো ৷ ট্রেন প্লাটফর্মে প্রবেশ করেছে ৷ আমরা বি-টু কম্পার্টমেন্টের নির্দিষ্ট সিটে গিয়ে বসে পড়লাম ৷ আমরা সবাই একই কম্পার্টমেন্টে ৷ সঠিক সময় ট্রেন ছাড়লো, আগামীকাল সকাল ১০.১৫ আমরা গৌহাটি পৌঁছাব ৷ঘটনাচক্রে খুব ঝড় বৃষ্টির কারণে কৃষানগঞ্জ সারারাত ট্রেন দাঁড়িয়ে ৷সকাল ছটায় ট্রেন ছাড়লো ৷ প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা লেট ৷ কয়েক কিলোমিটার দূরে গাছ ভেঙে লাইনের উপর পড়ার জন্যই এই বিপত্তি ৷ট্রেনে আমাদের পাশের সিটে জায়গা ছিল শংকর দাস নামের এক ব্যবসায়ীর ৷ পাঁচ পুরুষ ধরে ওরা গৌহাটি থাকেন ৷ ওই পরিবারের সঙ্গে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল ৷ ফোন নাম্বার দেওয়া নেওয়া হলো ৷ওরা নামল কামরূপ কামাখ্যা জংশন ৷ মাত্র সাত কিলোমিটার দূরে গৌহাটিতে আমরা নামব ৷ কামাখ্যার আগে পার হলাম পাগলাদিয়া নদী৷ খুব বড় নদী, এটি অসম রাজ্যের ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর বাহিনী উপ-নদী ৷এই নদীর উৎপত্তি ভুটান পাহাড়ের দেওথাং থেকে৷ বেলা সাড়ে তিনটেয় আমরা গৌহাটি পৌঁছালাম৷
আমরা উঠলাম গৌহাটি গেস্ট
হাউসে ৷ এটি পল্টন
বাজার ফেডারেল
ব্যাংকের একদম
উপরে অবস্থিত ।ছয়
তলা বিল্ডিং। লিফট যায় ৫ তলা
পর্যন্ত, ওইটুকু সিঁড়ি দিয়ে
উঠতে হলো ৷ এপ্রিল
মাস। দিনের বেলায় গরম
হলেও সন্ধ্যার পর থেকেই তাপমাত্রা
বেশ কমে যায় ৷
একটা চাদর গায়ে দিলে
হয় ৷ রাতে একটা
মোটা চাদর গায়ে দিলে
আরাম হয় ৷ দ্বিতীয়
সকাল পাঁচটায় রওনা হলাম কামাখ্যা
মন্দির দর্শন করবার জন্য
৷ তখনো হাজারখানেক লোকের
লাইনের পেছনে আমরা ৷
আমার এসব লাইন টাইন
পছন্দ না ৷ সবাই
যাচ্ছে তাই যাওয়া, লাইনগুলি পরপর, দর্শনার্থীরা বসে
থাকবেন। এবার একটি করে
লাইন ছেড়ে গ্রিলের খাঁচায়
প্রবেশ করবে । একদম চেন্নাইয়ের
তিরুপতি মন্দির এর মত
মাথার উপরে ফ্যান থাকলেও, ধৈর্যের পরিচয় দিতে দিতে
ক্লান্ত হাতে হয় ।হয়তো বেশ খানিকটা
পৌঁছে গেছি আমরা । আরও ৪০ থেকে ৪৫
মিনিটের মধ্যেই মন্দিরে প্রবেশ
করতে পারতাম।এরকম
সময় পেছন থেকে জুনিয়র
প্রদীপ আমাকে ডেকে বলে, 'দাদা, অসিতদা খুব অসুস্থ।
একটু দেখুন।' ভেবেছিলাম
ঠান্ডা জল খেলেই ঠিক
হয়ে যাবে।জল
খাওয়ার পর বমি
করল অনেকটা, আমি বেশ ভয়
পেয়ে গেলাম ৷ চিৎকার
করে এক সেবায়েতকে পেলাম৷ সেই ইমারজেন্সি
দোর খুলে দিল। আমরা সেই গেট দিয়ে
বেরিয়ে এলাম। অসিতকে মাঝখানে রেখে
আমি আর জুনিয়র প্রদীপ
ধরে নিয়ে উঁচু স্থান
থেকে মন্দিরের সামনে রাস্তায় নামলাম
৷ সন্ধান পেলাম মন্দিরের
একটা ক্লিনিক আছে ৷একটু দূরে,
সেখানে নিয়ে গেলাম ৷
ডাক্তার ছিলেন ৷ উনি
দেখে একটা ওনডেম ইঞ্জেকশন
করে দিলেন, সেইসঙ্গে
দিলেন রেবিপ্রাজল ডি গ্রুপের ওষুধ
৷ ওষুধ কিনে অটো
করে আমরা তিনজন গেস্ট
হাউসে ফিরে এলাম ৷
অন্যরা তখনও পূজার লাইনে
৷
বর্তমান কামাক্ষা মন্দিরটি অহোম রাজার রাজত্বকালে নির্মিত ৷এর মধ্য প্রাচীন কোচ স্থাপত্য সযত্নে রক্ষিত হয়েছে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় সহস্রাব্দের মাঝামাঝি সময়ে মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে ১৫৬৫ সাল নাগাদ কোচ রাজাদের চিল রায় মধ্যে যুগীয় মন্দিরের স্থাপত্য শৈলী অনুসারে মন্দিরটি পুনরায় নির্মান করে দেন৷
মন্দিরটি অসম রাজ্যের গুয়াহাটি শহরের পশ্চিম অংশে নীলাচল পর্বতে অবস্থিত৷ এটি ৫১ সতীপীঠের অন্যতম ৷ ৫১ টি শক্তিপীঠের , মধ্যে একটিতে ৪টি আদি শক্তি পীঠ গুলির মধ্যে ৷ কামাক্ষা মন্দিরটি দেবী সতীর গর্ভ এবং যোনি এখানে পড়েছিল ৷ এবং এইভাবে দেবী কামাখ্যাকে উর্বরতার দেবী বা রক্ত ক্ষরণকারী দেবী বলা হয়। এই মন্দিরটি হিন্দু তন্ত্রসাধকদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থক্ষেত্র।এই মন্দির প্রাঙ্গণে ত্রিশ দেবীর মন্দির রয়েছে ৷
আমাদের সঙ্গীরা সকলেই গেস্ট হাউসে ফিরল৷ তারপর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অটো নিয়ে গেলাম উমানন্দ ৷ সাড়ে তিনটেয় বন্ধ হয়ে যায় ৷ জানা যায় আগামী দিন সাড়ে ন'টা থেকে পুনরায় উমানন্দ মন্দিরে যাওয়ার লঞ্চ পাওয়া যাবে ৷ আমরা সবাই ফিরে এলাম গৌহাটির গেস্ট হাউসে৷ পরের দিন আমাদের কাজিরাঙা জাতীয় অরণ্যে যাওয়ার কথা।
সকাল সাড়ে ন'টার মধ্যে আমরা লঞ্চ ঘাটে পৌঁছে যাই ৷ টিকিট কেটে সবাই লঞ্চে বসি৷ ব্রহ্মপুত্র নদ এখানে খুবই চওড়া৷ পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম নদীদ্বীপ হচ্ছে উনানন্দ৷ এই দ্বীপেই উমানন্দ মন্দির স্থাপিত হয়েছে৷
গুয়াহাটি
শহরের প্রাণকেন্দ্র পার্কের বিপরীতে ব্রহ্মপুত্রের তীরে কাছারি প্রাঙ্গন
৷ আদালতের বিপরীতে ব্রক্ষপুত্রের জলে অতীতের ভস্মাচল
ও ভস্মকুট আজ হয়েছে পিকক আইল্যান্ড ৷এই
পাহাড়ি দ্বীপের টিলায় ঢঙে স্থাপিত
হয় উমানন্দ মন্দির ৷ মন্দিরে
দেবী কামাখ্যার ভৈরব শিব উপাস্য
দেবতা ৷ জনশ্রুতি এখানেই
শিবের ক্রোধাগ্নিতে কামদেব ভষ্মিভূত
হন। শিবরাত্রির
উৎসবে দূর-দূরান্ত থেকে
দর্শনার্থী ও ভক্তরা আসেন।এখানে আরো
দুটি মন্দির রয়েছে ৷
অহোম রাজাদের কালের। তবে আজ তা
অবহেলিত ৷ কয়েক ধাপ
নামতেই হনুমান মন্দির। কাছারী
ঘাট থেকে ফেরি লঞ্চে
পারাপার ৷ জলপথের মাঝ
দূরত্বে অতীতের উর্বশী আজ
বিধ্বস্ত ৷
গুয়াহাটিতে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দর। এবং অসমের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। সেখানে একটি তেল শোধনাগার এবং একটি রাষ্ট্রীয় খামার রয়েছে৷ শিল্প গুলির মধ্যে রয়েছে চা প্রক্রিয়াজাতকরণ কৃষি উৎপাদন এবং সাবান উৎপাদন ৷ ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় - গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়, এছাড়াও এখানে আর্ল ল কলেজ, রাজ্যের উচ্চ আদালত, স্টেট মিউজিয়াম, বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক মিউজিয়াম এবং একটি জুলজিক্যাল গার্ডেন রয়েছে৷ গৌহাটিতে রয়েছে একটি বিমানবন্দর ও একটি রেল স্টেশন। কয়েকটি অভয়ারণ্য রয়েছে এখানে৷ উল্লেখযোগ্য গুলি হলো- পোবিতারা অভয়ারণ্য, চক্রশিলা অভয়ারণ্য, রয়েছে মানস অভয়ারণ্য৷ ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে মনোনীত হয়েছিল ৷ শহরের প্রায় ১০০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর সরাইঘাট সেতু, রেল সড়ক সেতু গৌহাটির অন্যতম আকর্ষণ৷ এটি পূর্ব ভারতের একটি প্রধান বাণিজ্যিক ও শিক্ষা কেন্দ্র ৷ ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (আই.আই.টি)- র একটি ক্যাম্পাস গৌহাটিতে রয়েছে ৷
কোথাও কোথাও লেখা আছে আপনি ধপাত মুক্ত এলেকাত প্রবেশ করিছে। এর অর্থ হল you are in Tabocco free Zone . উনানন্দ দ্বীপের আর একটি নাম আছে তা হল - ময়ূর দ্বীপএবং ভস্মাচল পাহাড়। হোটেলে আসতে আসতে রাস্তায় দেখি লেখা রয়েছে ইয়াত ভাত পোরা যায়। অর্থাৎ এখানে ভাত পাওয়া যায়। লজে আমরা লাঞ্চ শেষ করে কাজিরাঙ্গা রওনা হলাম।
অসমের আর একটি আকর্ষন হল বশিষ্ঠ মন্দির। আমরা কাজিরাঙা ও শিলং ভ্রমনের পর বশিষ্ঠ মন্দির দর্শন করে গৌহাটি লজে ফিরে এলাম।
বশিষ্ঠ মন্দির:- এই মন্দিরটি গুয়াহাটি শহরের ১২ কিলোমিটার দক্ষিনে সন্ধ্যাচল পাহাড়ে অবস্থিত । এখানে মুনির পায়ের ছাপ সংরক্ষিত রয়েছে এবং মূর্তিও তৈরি হয়েছে৷ সন্ধ্যা, ললিতা, আর কান্তা নামের তিনটি পাহাড়ি নদী আশ্রমের সবুজ ক্ষেত্রকে অতিক্রম করে চলেছে।
বশিষ্ঠ সপ্তর্ষিদের একজন হিসেবে পরিচিত। তিনি ঋকবেদের সপ্তম মন্ডলের ও অন্যান্য বেদের ঋষি। এর নাম অরুন্ধতী৷ এছাড়াও তিনি অক্ষমালা নামক শূদ্র কন্যার প্রতি আসক্ত হয়ে তার সাথে মিলিত হন৷ বশিষ্ঠের সংস্পর্শে এসে পরম গুণবতী নারী রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন ৷এই ঋষির নামে উত্তর পূর্ব আকাশে একটি তারা আছে ৷ ব্রহ্মার সপ্তম মানসপুত্র এবং প্রজাপতি। এ সবই পুরাণের কথা।
আমাদের টিম ম্যানেজার বুড়ি আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করল একটা হোটেলে৷ ওরা দুপুরের খাবার রান্না করে এনেছিল শিলং থেকে' শুধু বসে খাওয়ার জন্য ৫০০ টাকা দিতে হলো৷ গুয়াহাটির কিংবদন্তি ও ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের পুরোনো৷ ইতিহাসের উল্লেখ করা কাহিনীগুলি থেকে এটাকে এশিয়ার একটি অন্যতম পুরনো নগর হিসাবে অনুমান করা হয়৷ বশিষ্ঠ মন্দিরের পাশে যে নদীটি বয়ে চলেছে, ২৫ বছর আগে তাকে যে রূপে দেখেছিলাম তার সিকিও এবার দেখতে পাইনি৷ এবার বশিষ্ঠ আশ্রম দেখে আমার মোটেই সেই উচ্ছ্বালতা চোখে পড়েনি। কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও যত্রতত্র ঘরবাড়ি তৈরি এবং দূষণ একমাত্র কারণ বলে মনে হয়৷