স্বাধীনতা দিবস ও আরও কয়েকটি দিবসের কিছু কথা
কলমে : নির্মল বিশ্বাস
ছবি : সায়ন ঘোষ, বনগাঁ
আদিমকাল থেকে শুরু করে একবিংশ শতাব্দীর তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর মহাকাশচারী জেটযুগের মানুষ ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়েই আধুনিকতার অভিমুখে এগিয়ে চলছে। তেমনই ভারতের স্বাধীনতা দিবসটিও গুটিগুটি পা-এ এই দিবসটি ৭৫ বছর পূর্ণ করলো। তেমনই রয়েছে আরও একটি দিবস সেটি হল প্রজাতন্ত্র দিবস। স্বধীনতার ৭৫ বছর পর দেখছি সারা বিশ্বে এখন অসখ্য দিবসের ছড়াছড়ি। কেন এতো দিবসের পালন? তাহলে এই দিবস- গুলিকে নিয়ে একটু পর্যালোচনা করা যাক। আমাদের দেশ সত্যি কি এগিয়েছে?
এই ধরুন, ফ্রেন্ডসিপ ডে থেকে শুরু করে জল দিবস, আবার শিক্ষক দিবস, শিশু দিবস, নারী দিবস, আইসক্রিম দিবস। আবার চকলেট ডে থেকে ডায়াবেটিস দিবস। ভ্যালেন্টাইন দিবসের কথা আর নাই বা বললাম। ওই দিনটিতে লক্ষ লক্ষ ভালোবাসা কার্ড বিকিয়ে যায় সারা বিশ্বে। কোটি কোটি টাকার খেলা চলে। লক্ষ লক্ষ গাছ লোপাপ হয়ে যায় একমাত্র ওই দিনটির জন্য ভালোবাসার কার্ড বানাতে। পরিবেশের অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সারা বিশ্ব কত গাছ যে নির্মূল হয়ে কাটা পড়ে। সে হিসাব শুনলে একটু মন খারাপ হয়ে যায় বইকী। আবার, শিক্ষার মূল উপাদান বই-খাতা কাগজ তাহলে সেসব আসবে কোথা থেকে? আপনি কি চইবেন শিক্ষা জগৎটা নির্মূল হয়ে যাক?
এই ক'দিন আগেই তো পরিবেশ দিবসটি পালিত হয়ে গেল। পরিবেশবিদরা এ বাপারটা নিয়ে কখনও ভেবেছেন কি? কিন্তু এখন সে কথা বলার সময় নয়। তাহলে আমাদের আগামী ফেব্রয়ারি মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকতেই হবে ওই ভালোবাসা দিনটির জন্য। অতএব, আপাতত তোলা থাক এই দিন দুটির কথা।
এই লেখাটি লেখবো বলে যেদিন ভেবেছি, সে দিনটাকে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। আজ গোটা বিশ্বের দিকে তাকালে এক ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখতে পাবো। নানান সামাজিক জটিলতায় ও টেনশনে দুনিয়ার এদিকে সেদিকে কত কোটি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এই মধুমেহ দিনটিতে ছেড়ে যদি একটু এগিয়ে যাই তাহলে আরও অনেকগুলি দিবসের সন্ধান পাবো। সেসব দিবস বা দিন শুধু আনন্দের জন্য নয়, অনেক ভয়াবহতার সন্ধান দিচ্ছে এই বিশ্বকে।
যেমন, জল দিবস। জল দিবস এলেই জানা যায় সারা বিশ্ব আজ কত গভীর সঙ্কটের মুখে একটু পানীয় জলের জন্য। একদিকে জলাধার শুকিয়ে যাচ্ছ, অন্যদিকে জলাধার বা পুকুর বুজিয়ে বহুতল গজিয়ে উঠছে। এমন নানা সমস্যায় আজ জলের সঙ্কট গোটা বিশ্ব জুড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে শুরু করে ইথুওপিয়া। সুদূর থাইল্যান্ড মতো আরও অনেক দেশ আছে যেখানে জলের জন্য মানুষকে কত মূল্য চোকাতে হয়। এমন কী আমাদের দেশের রাজস্থানেই তো গভীর হাহাকার-এর ছবি আমরা দেখতে পাই টিভির পর্দায়। এমন কী একটু পানীয় জলের জন্য নারী শরীর বিকোতেও দেখা গিয়েছে বিশ্বর কোথাও কোথাও। তাই সংবাদ মহলের আশঙ্কা আগামী দিনে একটু জলের জন্যই নাকি বিশ্ব যুদ্ধ হতে পারে।
জল দিবস থেকে শিশু দিবস। অন্যায়, অত্যাচার ও অনিয়মের স্রোতে ভেসে যাওয়া আমাদের এই দেশ যখন কন্যাভ্রূণ হত্যার মহোৎসবে মেতে ওঠে, তখন আর বিস্ময় জাগে না। দেশের উন্নয়নের বাজনা এই অবিচ্ছিন্ন অপরাধের সংবাদ শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় না। প্রতি বছর এদেশে কম করেও পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি কন্যাসন্তন মাতৃগর্ভে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। গর্ভধারণের গর্ভধারিণী মা মূলত পারিবারিক বা, অর্থনৈতিক চাপে এই খুন মেনে নেন, বলা ভালো, বাধ্য হয়েই মেনে নিতে বাধ্য হন।
আমাদের এইদেশ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। নারী-পুরুষের ভারসাম্য রক্ষা করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে বেমালুম উপেক্ষা করে এই হত্যালীলার ইন্ধন জোগায়। দেশের নানা নার্সিংহোম ও প্যাথলিক্যাল ল্যাবরেটারিতে কন্যাভ্রূণ নির্ধারণের ব্যবসা রমরমিয়ে চলতে থাকে। অথচ সরকার আইন করেও তা বন্ধ করতে পারেনি। এই জঘণ্যতম অপরাধ বন্ধ করতে সরকার শুধু দিশেহারা নয়, পুরোপুরি ব্যর্থ। সেই ব্যর্থতা ঢাকতে 'পালনা' নামে একটা প্রকল্প চালু করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই সরকারের অধীন মহিলা ও শিশু উন্নয়ন দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রীর আবেদন, 'আপনি আপনার কন্যা সন্তানকে খুন না করে বরং জন্মের পর সরকারকে দিয়ে দিন। সরকার তার দায়ভার নেবে।' এই নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, 'সরকারের নেওয়া এই দত্তক কন্যা সন্তানদের সামাজিক পরিচয় কী হবে?' প্রাণে বেঁচে যাওয়া কন্যাটির লেখাপড়া, কর্মসংস্থান ও সংসার জীবন কীভাবে বাস্তবায়িত হবে? সে ব্যাপারে সরকার কোনও স্পষ্ট রেখাচিত্র দিতে পারেনি। আমাদের ভয় হয়, একটি অবক্ষয়কে বন্ধ করতে গিয়ে আর একটি অবক্ষয়ের জন্ম হবে না তো?
আরও একটি দিবস। সেটি হল নারী দিবস। অথচ এই দিবসকে উপেক্ষা করে এতো সবের মধ্যে ধর্ষণ, গণ-ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির ঘটনা প্রতিদিন দৈনিক সংবাদপত্র বা টিভির পর্দায় স্থান করে নিচ্ছে। সম্পর্কের বেড়াজালেও ধার ধারছে না। কখনও বয়সের ফারাক চমকে দিচ্ছ এই সমাজকে। কিন্তু যেভাবে নিয়মিত এসব ঘটনা ঘটছে তা যথেষ্ট চিন্তার বিষয়।
অর্থ, নারী, সুরা বা মদের প্রতি একশ্রেণি মানুষের দুর্বলতা আদিকাল থেকেই। যুগ যত এগিয়েছে এই দুর্বলতা ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে নারীদের প্রতি যৌন আক্রমণ বরাবরই ছিল। এখন অসম্ভব বাড়ার কারণ, প্রথমত, মেয়েরা কাজের জন্য রাস্তায় বেরিয়েছে। দ্বিতীয়ত, নারীরাই পুরুষের প্রতি যৌন আক্রমণ ঘটানোর সাহস দেখাচ্ছে। তৃতীয়ত, আঁটোসাটো ও খোলামেলা পোশাক। সংবাদ মাধ্যমও আগের তুলনায় আজকাল আরও শক্তিশালী হওয়ায় ঘটনাগুলি অনেক বেশি প্রকাশ্যে আসছে।
আমাদের সমাজে একটি মারাত্মক রোগের প্রচলন আছে। সেই রোগটি হচ্ছে বিপরীত লিঙ্গকে স্পর্শ করার লোভ। আর তা থেকেই যাবতীয় বিপত্তির সূচনা। বাঙালি তথা ভারতীয় নারীর সৌন্দর্য ইতিহাস বিখ্যাত। নিম্নবিত্ত, সাধারণ ঘরেও নারী রূপের ঘাটতি নেই। কোনও জিমে না গেলেও তাদের দেহ সৌষ্ঠব যথেষ্ট আকর্ষণীয়। তাছাড়া, কাজের সুবিধার জন্য শরীরের আঁটোসাটো পোশাক, যা দেখে অতি বড় শিক্ষিত পুরুষের মনেও চিত্ত চাঞ্চল্য জাগা স্বাভাবিক। অনেকে সেই রাশটা টেনে রাখতে পারলেও একদল পারছে না। তার ফলেই ঘটছে অঘটন। সমাধান সূত্র হিসাবে, প্রশাসনকে আরও শক্ত ও কঠোর হওয়া প্রস্তাব। সত্যই সেটা একেবারেই হাস্যকর। তাহলে তো প্রত্যেক নারীর জন্য সঙ্গে একজন করে পুলিশ দিতেই হয়। তাহলে সমাধান সূত্র হিসাবে আপনার কী মত?
তেমনই একটি নির্দিষ্ট দিনও নির্ধারিত হয়েছে প্রবীণ দিবস বা বার্ধক্য দিবস রূপে। যাকে বলা হয় ওল্ড এজ ডে। প্রতি বছর পয়লা অক্টোবর দিনটিকে স্মরণ করা হয় প্রবীণ দিবস হিসাবে।
আমাদের সমাজে আনাচে কানাচে প্রায় প্রতিটি ঘরে রয়েছেন তাঁরা। আজ কেমন আছেন তাঁরা? দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায় কিছু না কিছু তিক্ত যন্ত্রণার ছবি দেখতে পাই। আবার শুনতেও পাই, পুত্রের হাতে পিতার নিগ্রহ থেকে শুরু করে পুত্রবধূর দ্বারা স্বামীহীন শাশুড়িকে বাড়ি থেকে বিদেয় করে দেওয়ার মতো অজস্র ঘটনা যা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে ঘটে চলেছে। কেউ বা মুখ বুজে সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার কেউ এই অসহনীয় কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আশ্রয়ের করুণা পেতে আদালতে যাচ্ছেন। আদালত ধমক দিয়ে সন্তানকে শেখানো হচ্ছে, 'সন্তানের কি কর্তব্য বাবা-মায়ের প্রতি।' ছোটবেলায় পাঠ্য পুস্তকে পড়েছি, গুরুজনদের প্রতি সন্তানের কি কর্তব্য। সেই কাজ আজ আদালতকে মধ্যস্থতা করতে হচ্ছে।
যে সন্তানদের মানুষ করতে বাবা-মা অজস্র ত্যাগ ও অপমান নীরবে বয়ে বেরিয়েছেন, ত্যাগ তিতিক্ষা সয়েছেন। সেই পুত্র কন্যার মধ্যমে যখন তাঁরা গৃহহীন, লাঞ্ছনা, নিরাপত্তাহীন অসহনীয় জীবন কাটিতে বাধ্য নয়, তখন বিবেকহীন সমাজেরই এক করুণ ছবি উঠে আসে আমাদের সামনে। সেই অবস্থাকে বদল করতে হলে আরও অনেক বেশি সহমর্মিতার ও সমবেদনা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের ঘরে বাইরে আরও অনেক বেশি সচেতনার প্রয়োজন।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সন্তান হিসাবে পিতা মাতার প্রতি অনেক কর্তব্য থাকে। যদি আমরা শক্ত সামর্থ শরীরে পিতা মাতাকে অপমান অবহেলা করি। তাহলে আগামী প্রজন্মের কাছে আমরাই দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবো। পিতা মাতার প্রতি যাঁরা এমন অমানবিক আচরণ করেন, তাঁরা বোধহয় ভাবেন না, তাঁদেরও একদিন বয়স বাড়বে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা হবেন। সমাজের কাছে রেখে যাওয়া দৃষ্টান্ত, তাঁদের শিশু সন্তানেরা তো এমন অমানবিক আচরণ দেখতে দেখতে বড় হবে। ঠাকুরদা, ঠাকুরমা কিংবা দাদু, দিদাদের অবহেলার ছবি দেখে নিজেদের বাবা মার প্রতি অবজ্ঞা ও ঘৃণা জন্ম নেবে।
প্রতিশেষে এটাই বোঝা গেল---এতো সহজে এই সমাজ বদল হবার নয়। আমাদের অভিযান চলতেই থাকবে।