বেণীমাধব শীলের "পঞ্জিকা" আজও অম্লান ও অক্ষয়
নির্মল বিশ্বাস
হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান অন্নপ্রাসন, সাধভক্ষন, পৈতে, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদি অনুষ্ঠান শুরু করে নানা পূজা পদ্ধতি সহ ভ্রমণ, বিভিন্ন শুভ সময় নির্ধারণ করার একটি সহজ পদ্ধতি এই পঞ্জিকা। আবার এই পঞ্জিকা থেকেই জানা যায় সৃর্যাস্ত-সূর্যোদয়, নদীর জোয়ার-ভাটার সঠিক সময়। সব কিছুতেই পঞ্জিকা ছাড়া বাঙালির এক মুহূর্তও চলে না। সাম্প্রতিককালে আমরা আধুনিকতায় বিশ্বাসী হই না কেন, যে কোন মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানে শুভ দিনক্ষণ বিচার করতে একমাত্র ভরসা এবং বাঙালি জীবনের সঙ্গে ওতোপ্রতভাবে জড়িয়ে রয়েছে এই পঞ্জিকা। যখন কোনও পুরোহিত বা জ্যোতিষী কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে, পঞ্জিকার নিয়ম ব্যতীত কিছুই করতে সাহস দেখান না।
সেই কবে, আমার ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকার কথা। পুজোর পর থেকেই শুরু হয়ে যায় নতুন বছরের পঞ্জিকা তৈরির কাজ। সারা বছরভর পণ্ডিতেরা পুনর্মার্জন ও সংশোধন করে থাকেনস। আবার নতুন বছর আসার আগেই বিক্রির জন্য বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি বাসে ট্রামে ট্রেনে হকারেরা হেঁকে হেঁকে বিক্রি করেন বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা। তবে এই পঞ্জিকা বিক্রির ক্ষেত্রেও একমাত্র 'রামকৃষ্ণ কথামৃত' ছাড়া এর ধারে কাছে কেউই পৌঁছতে পারেনি আজও। বর্তমান বিক্রির দিক থেকে পঞ্চাশ লক্ষেরও বেশি।
বহুকাল আগে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় একশ' ষাট-বাষট্টি বছর আগে এক সময় বেণীমাধব শীল-এর পরিবার বাস করতেন হাওড়া জেলার মকড়দহ অঞ্চলে। সে সময় মোহনচাঁদ শীলের প্রপিতামহ দ্বারিকনাথ শীল চাকরির খোঁজে কলকাতায় আসেন। সেদিন অবশ্য দ্বরিকনাথ আশ্রয় পেলেন উত্তর কলকাতায়, বর্তমান জয়া মিত্র স্ট্রিটে। আর চাকরি পেলেন বর্তমান পোস্তা বাজারের সন্নিকটে পুরনো ট্যাঁকশালে। এরপর তাঁর ছেলে পূর্ণচন্দ্র শীলই প্রথম প্রকাশ করেন বাংলা ডাইরেক্টারি পঞ্জিকা। তিনি সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত থাকার করণেই বাধ্য হয়ে মা মনমোহিনী দেবীর হাতে ব্যবসার ভার তুলে দেন।
পূর্ণচন্দ্রের সন্তান বেণীমাধব শীল চাকরিতে যোগ না দিয়েই ব্যবসায় মননিবেশ করেন। তাঁর হাত ধরেই পঞ্জিকা হয়ে ওঠে সর্বজনবিধিত 'বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা। শোনা যায়, সেই পরাধীন ভারতেও ক'য়েকজন কৃতি ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরা ব্যবসায়েে আগ্রহ হয়ে তাঁদের নাম জুড়ে দেওয়া হয় পঞ্জিকায়। ক্রেতাদের মনে সন্দেহ ও ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেন। ক্রেতাদের প্রতি বিশ্বাস অর্জনের জন্যই তিনি পঞ্জিকাতে নিজের ছবি ব্যবহার করেন। এ প্রসঙ্গে এক সাহেব প্রফেসর ফিলিপ কটলারসন বেণীমাধবের ব্যবসার উন্নতি দেখে তিনি বলেছেন, 'এক শতাব্দী অতিক্রান্ত করিয়াও কোন ব্যবসায়ী ইহাহেন সৎ সাহস দেখাইতে পারিবে না।' এরপর বেণীমাধব প্রয়াত হন ১৮৮৯ সালে। এরপর এই কোম্পানির মালিক হন দুই ছেলে। বড় ছেলে মোহনচাঁদ ও ছোট ছেলে অভিজিৎ। মেজ ছেলে শশাঙ্ক শীল মারা যান ১৯৯৯ সালে।
দুটি ইফতার পার্টি ঘিরে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল বাগদায়
বর্তমান উত্তর কলকাতার শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনের কাছেই অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিটের পাঁচতলা বাড়িটি এখন বেণীমাধব শীলে পঞ্জিকার অফিস এবং এই বাড়িত বসবাস করেন পরিবারের সকলে। মোহনচাঁদের একটি মেয়ে পৌলোমী শীল ভট্টাচার্য। অভিজিৎ-এর দুই ছেলে অভিদেব ও অভিরণ। এরা ভাই-বোনেরা একত্রে বাবা জ্যাঠা মহাশয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
এই পঞ্জিকা কখনও সখনও অহিন্দুরাও প্রায়শই ব্যবহারিক তথ্যের জন্য এই পঞ্জিকায় প্রকাশিত তথ্যের পরামর্শ নিয়ে থাকেন। আবার এই পঞ্জিকাতে মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য উৎসব, অনেক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির জন্ম ও মৃত্যু তারিখও লিপিবদ্ধ রয়েছে ও জ্যোতিষ শাস্ত্র সম্পর্কিত তথ্যমূলক নিবন্ধ থাকে পঞ্জিকাতে। পঞ্জিকা সাধারণত বাংলা, ওড়িয়া, মৈথালী ও অসমিয়া ভাষায় প্রকাশিত হয়। এই পঞ্জিকাকে অনেকে পাঁজি বলে থাকেন। আবার ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে একে 'পঞ্চঙ্গম' বলে থাকেন। এই বইটি ভারতে সর্বাধিক জনপ্রিয় বার্ষিক প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে অন্যতম।
আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের কারণে হিন্দু পঞ্জিকার অসংখ্য সংস্করণ দেখা যায়। এদের মধ্যে অধিক প্রভাবশালী পঞ্জিকাগুলো হল, নেপালের সরকারি নেপালি পঞ্জিকা এবং সর্ব ভারতীয় ক্ষেত্রে বাংলা পঞ্জিকা, পাঞ্জাবি পঞ্জিকা, ওড়িয়া পঞ্জিকা, মলয়ালম পঞ্জিকা, কন্নর পঞ্জিকা, টুলু পঞ্জিকা, তামিল পঞ্জিকা, বিক্রম সংবৎ ও দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, তেলঙ্গনা আর অন্ধ্রপ্রদেশের শিলিবাহন পঞ্জিকা।
গাইঘাটায় বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেমিকার সাথে সহবাস, ধৃত প্রেমিক
আঞ্চলিক হিন্দু পঞ্জিকার বৈশিষ্ট্য হল বারোটি মাসের নাম সব পঞ্জিকাতে একই আছে। যদিও বিভিন্ন অঞ্চলে বছরের প্রথম মাসটি বিভিন্ন। আবার কম্বোডিয়া, লাওস, মায়নমার, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ, বর্ষপঞ্জি আর কিছু সৌর চান্দ্র নক্ষত্র ইত্যাদি হিন্দু পঞ্জিকাই প্রাচীন সংস্কারের উপর প্রতিষ্ঠিত। মুসলিম পঞ্জিকাও চান্দ্র নক্ষত্রের উপর নির্ভর করেই সমস্ত ক্রিয়াকর্ম পরিচালিত হয়ে থাকে।
১৯৫৭ সালে এই হিন্দু পঞ্জিকার উপর ভিত্তি করেই ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জি শক সংবৎ গঠিত হয়। তবে পঞ্জিকা অতীতের বৈদিক যুগ থেকেই প্রচলন হয়ে আসছে। হিন্দু পঞ্জিকার গঠন সম্পর্কে সর্বপেক্ষা স্বচ্ছ ধারণা দেয় 'সূর্য সিন্ধান্ত' নামে গ্রন্থটি। এর সঠিক রচনাকাল জানা যায় না। তবে কারও কারও অভিমত এটি দশম শতাব্দীতে রচিত হয়েছিল। প্রাচীন বৈদিক পঞ্জিকায় বছরের শুরু হত অগ্রহায়ন বা মার্গশীর্ষ মাস দিয়ে। এই মাসের অপর নাম মার্গশীর্ষ এসেছে পঞ্চম নক্ষত্র মৃগশিরা নবম থেকে।
বেশিরভাগ হিন্দু পঞ্জিকাই পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে গুপ্তযুগে আর্যভট্ট ( পঞ্চম ), বরাহ মিহির ( ষষ্ঠ ) ও ভাস্কর ( দ্বাদশ ) জ্যোতির্বিদ্যার ফসল। এই জ্যোতির্বিদ্যার মূল আধার হল প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থ বেদাঙ্গ জ্যোতিষ, যা পরে সংস্কার করে 'সূর্য সিদ্ধান্ত' গ্রন্থটি লিখিত হয়। মধ্যযুগে এই পঞ্জিকার আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হতে থাকে। দ্বাদশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় ভাস্কর জ্যোতির্বিদ্যার নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেন।
এই সপ্তাহের (PDF) কাগজ দেখার জন্য এই লিংকে ক্লিক করুন
তবে এও শোনা যায়, বাঙালির আদি পঞ্জিকা হল, 'নবদ্বীপ পঞ্জিকা'। ঐতিহাসিকদের অনুমান এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সম্ভবত 'স্মার্ত রঘুনন্দন'। যা অষ্টাদশ শতাব্দীতে কৃষ্ণনগরের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় ( ১৭১০-১৭৮২ ) আমলে রামরুদ্র বিদ্যানিধি নতুন করে গণনা শুরু করেন। আগের দিনে তালপাতার পুঁথিতে সব কিছুই লেখা হত প্রথম ছাপার অক্ষরে ছাপা শুরু হয় উনিশ শতকের অর্থাৎ ১৮৬৯ সালে।
বর্তমানে বাজারে পাঁচ ছয় রকমের পঞ্জিকা মেলে। তেমনই বেণীমাধব শীলের সাত ধরণের পঞ্জিকা বাজারে পাওয়া যায়। সব পঞ্জিকার শুরুতে থাকে বেণীমাধব শীলের নাম জ্বলজ্বল করে। তার নীচে লেখা থাকে ডাইরেক্টারি পঞ্জিকা, ফুল পঞ্জিকা, হাফ পঞ্জিকা, পূর্ণাঙ্গ পঞ্জিকা, গার্হস্থ্য পঞ্জিকা ও পকেট পঞ্জিকা। তেমনই বিভিন্ন সাইজ ও পৃষ্ঠার কারণে দামের হেরফের রয়েছে। বিশেষ করে বাঙালিদের মধ্যে বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকাটি হল অন্যতম জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত। বাঙ্গালির কাছে বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকা আজও অম্লান ও অক্ষয়।