গল্প
ঝাপসা মানুষ
➧ উত্তরে হাওয়া সঙ্গে বৃষ্টি। ঠাণ্ডাটা বেশ জমিয়ে পড়েছে। নিম্নচাপের মেঘ থাকবে আরো দুদিন, আবহাওয়া দপ্তরের খবর। কাল সকাল থেকেই শুরু হয়েছে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। সুতরাং শনিবারের অফিস একটার মধ্যে ফাঁকা। শিয়ালদা আসতে আসতে সমীরণ ভাবছিল যদি দুর্যোগ দুদিন থাকে তো সোমবার কলকাতা ভাসবে। তাহলে সোমে একটা স্পেশাল লিভ। মঙ্গলে একটা ক্যাজুয়াল আর বুধবার তো ক্রিসমাস ডে। পরপর চারদিন ছুটি। ভাবা যাচ্ছিল না।
তার ভাবনাটা বোধহয় সত্যি হতে চলেছে। আজ ভোর রাত থেকে যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে সেটা কলকাতায় হলে নির্ঘাত এখন কলকাতা ভাসছে। টিভিতে খবরটা দেখবে কিন্তু কারেন্ট নেই। খবরের কাগজ বেলা সাড়ে নটার সময়ও পৌঁছায়নি। আজ সব কিছুই দেরি করে শুরু হয়েছে। ভোরের বৃষ্টি, ছুটির আমেজ, দাম্পত্যের উষ্ণতা, লেপের ওম সব মিলিয়ে একেবারে ফাটাফাটি ব্যাপার। সুতরাং বিছানা ছাড়তে নটা বেজে গেল। জানলা খুলতেই তীব্র হাওয়া ঝাপটা মারে। না খুলেলও উপায় নেই। এই দিনের বেলাতেও ঘরের মধ্যে অন্ধকার। তবে সুখের কথা রণিতার মুখে কোনো অন্ধকার নেই। অবশ্য থাকার সঙ্গত কারণ ছিল। কাজের লোক আসেনি। আসার সম্ভবনাও নেই এই বৃষ্টিতে। অন্য দিন হলে দেখতে হতো না। তবে আজ রণিতার গায়েও ছুটির আমেজ, বিছানার উষ্ণতা লেপ্টে আছে। সোফায় বাবু হয়ে বসে গরম চা আর খবরে কাগজের অপেক্ষায় সমীরণ। রান্নাঘরে কাপ প্লেটের ঠুংঠাং রণিতার চুড়ির টুংটাং, বৃষ্টির রিমঝিম শব্দ এক সুন্দর কনসার্টের মতো বাজছিল তার কানে। ঘুম থেকে উঠে রুম্পা এসে তার কোলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। চাদর সরিয়ে পাঁচ বছরের মেয়েটাকে একেবারে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল সমীরণ।
মেয়ের গালে গাল ঠেকিয়ে আদর করতেই মেয়ে বললো,
"আজতো রবিবার। তোমার ছুটি তাই না বাপি?"
“হ্যা আজ সবার ছুটি।" সে বলে। অমনি মেয়ে গাল ফোলায়।
"আমার আবার ছুটি কই! একটু পরেই তো ড্রয়িং শেখাতে আসবে কাকু।"
" না। আজ আর কাকুকে আসতে হবে না। আমি ফোন করে বারণ করে দিচ্ছি।"
‘সত্যি! কি মজা, কি মজা।" হাততালি দেয় রুম্পা।
দু-কাপ চা এক গেলাস কমপ্লান টেবিলে নামায় রনিতা। "বিস্কুটের কৌটোটা নিয়ে আয় তো মা।"
"আনছি মামণি।" রুম্পা রান্নাঘরে দৌড় দেয়। "আজ তাহলে তোমারও ছুটি।"
"আমার আবার ছুটি কি?", হাসে রণিতা। "আমার ছুটি হলে তো সবার খাওয়া-দাওয়াও ছুটি হয়ে যাবে।" গলায় অভিমানের ছোঁয়া টের পায় সমীরণ।
রুম্পাকে কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলে,"বললাম তো আজ সবার ছুটি। আজ রান্না বনধ্। আমি হোম ডেলিভারিতে ফোন করে দিচ্ছি। শুধু কি মেনু হবে বলে দাও।"
চায়ে চুমুক দিতে দিতে রণিতা বলে, "থাকগে আমিই করে নেব। মাসের শেষে শুধু শুধু একগাদা বাজে খরচ।"
"ঐ তোমার এক দোষ রুণু। সবসময় হিসাব করলে হয়! দু-একদিন অন্যরকম হতেই পারে।"
রুম্পা সায় দেয়, "হ্যাঁ মা, আজ আমাদের সবার ছুটি আমরা কেনা খাবার খাব। বাবা ফোন করে দাও তো।"
মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হেসে রণিতা বলে, "ঠিক আছে আমাদের দুজনের কথাই থাক। আজ আমার হাফ ছুটি। সকালের জলখাবার তোমার বাপি কিনে আনুক আর দুপুরে খিঁচুড়ি, ডিম ভাজা আমি বানাব। কি চলবে তো?”
“হ্যাঁ,হ্যাঁ চলবে।" বাপ মেয়ে দুজনেই সোল্লাসে সমর্থন জানায়।
রুম্পা কমপ্লানের গেলাস হাতে নিয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখতে থাকে।
হঠাৎ বলে – “দেখো বাপি যীশু পাগলটার কি কষ্ট। আহারে খুব শীত লাগছে বেচারির।"
রুম্পাকে অনুসরণ করে জানলার বাইরে তাকায় সমীরণ। তাদের ঘরের সামনে তিন দিক খোলা একটা চণ্ডীমণ্ডপ। মণ্ডপের একমাত্র দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে গুটিশুটি হয়ে পাগলটা বসে। এ অঞ্চলে সবাই ওকে যীশু পাগল বলে। ছ'ফুটের বেশি লম্বা, কাধ পর্যন্ত নেমে আসা তামাটে চুল, মুখে তামাটে দাড়িগোঁফের আস্তরণ। লোকটার উর্দ্ধাঙ্গ নিরাবরণ। একটা ত্যানা কোমর থেকে নেমে হাঁটুর উপরে গুটিয়ে আছে। কোমরের দড়িতে কয়েকটা প্লাস্টিকের খালি বোতল বাঁধা। সারাদিন শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জুড়ে তার পরিব্রাজন। সারাক্ষণ কি যেন বিড় করে। কিন্তু কখনো চিৎকার করে না। খাবার প্রয়োজন হলে, যে কোনো খাবারের দোকানের সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। হাত বাড়িয়ে চায় না। কোনো কথা বলে না। শহরের মানুষ এ পাগল কে আর পাঁচটা ভিখারী বা পাগলের সঙ্গে এক চোখে দেখে না। কেউ ঘৃণা করে না বরং করুণা করে। হয়তো বা সমীহও। সে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু চায় না। সুতরাং প্রত্যেক দোকানিই তাকে কিছু না কিছু দেয়। আবার যদি কেউ না দেয় তাহলেও তার ভ্রুক্ষেপ নেই। চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চলে যায়। আজ মাস দুয়েক পাগলটা এই মণ্ডপে আশ্রয় নিয়েছে। সারাদিন চক্কর মেরে রাতে এসে বিশ্রাম নেয়। এখানে মাথার উপর একটা ছাদ আছে, হয়ত পাগলেরাও মাথার উপর একটা ছাদের নিরাপত্তা চায়। আজ বৃষ্টিতে সে কোথাযও বেরোতে পারেনি। কনকনে ঠাণ্ডায় কাঁপছে থরথর করে।
"ইস! মাগো ওর খুব শীত করছে বোধ হয়।" রুম্পা বলে।
সমীরণের মনে একটা অপরাধ বোধ কাজ করতে থাকে। কারণ রোজ রাতে সে যখন অফিস থেকে ফেরে দেখে, পাগলটা বসে আছে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। কোনদিন বা শুয়েও থাকে।সমীরণের নিজের গায়ে থাকে ফুলহাতা সোয়েটার মাথায় গরম টুপি, গলায় মাফলার। লোকটার পাশ দিয়ে রোজ বাড়ি ফেরে সে। প্রতিদিন লোকটাকে দেখে আর ভাবে। এই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় আদুল গায়ে কিভাবে ঘুরে বেড়ায়! পাগলদের কি শীত বোধও কম! রোজ রাতেই সে ভাবে নিজের একটা পুরানো সোয়েটার ওকে দেবে। যথারীতি বাড়ি ফিরে রোজ ভুলে যায়। এই ভাবে দিন দশেক কেটে যায়। শেষে একদিন ঘরে ঢুকেই রণিতাকে বলে, "আমার একটা পুরানো সোয়েটার খুঁজে রেখো তো।'
“ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই পুরানো সোয়েটারের কি প্রয়োজন হল।" রণিতা অবাক হয়।
"এদিকে এসো।" বলে রণিতাকে টেনে নিয়ে গেছিল বন্ধ জানলার সামনে। এক ঝটকায় জানলা খুলে দিয়েছিল।
"এই কি হচ্ছে কি। মেয়েটা ঘুমচ্ছে ঠাণ্ডা লেগে যাবে।"রণিতা বুঝতে পারছিল না কী করতে চাইছে সমীরণ।
"ঐ মণ্ডপে দেখো। পাগলটা ঐ খোলা জায়গায় কিভাব ঘুমচ্ছে।"
"তো কি হয়েছে? ও তো রোজই ঘুমায়।" রণিতার অবাক প্রশ্ন। "আহা দেখতে পাচ্ছ না বেচারি এই প্রচণ্ড শীতেও খালি গা? সোয়েটারটা ওকে দেব।”
"ঐ পাগল থেকেও তো তুমি বেশি পাগল দেখছি।"হেসে ফেলে রণিতা। ‘পাগলের আবার শীত গ্রীষ্ম আছে নাকি! ওকে কোনদিন জামা পরতে দেখেছ?কেউ ওকে কোনোদিনই দু একটা ছেঁড়া জামা দেয়নি এমন হয় নাকি! আসলে ও নিজেই ও সব পরতে পারে না।তা ছাড়া তোমার নিজের কটা সোয়েটার আছে মশাই যে তুমি অন্যকে দেবে! ঠিক আছে আমি খুঁজে দেখব।" বলতে বলতে রণিতা জানলা বন্ধ করেছিল।
তারপর কয়েকদিন পাগলটাকে সে ভালো করে লক্ষ্য করত। রণিতার যুক্তি মনে ধরেছিল। সত্যিই তো নিশ্চয় ওর শীত করে না। তাহলে যেমন করে খাবার জোগাড় করে তেমন করে একটা গরম জামা ও জোগাড় করে ফেলতে পারত। আবার এমনও হতে পারে লোকটা জামা পরার কায়দা-কানুন ভুলে গেছে। তাই হয়ত খালি গায়েই থাকে। নিজের যুক্তিতে নিজেই হেসেছিল সে। ধুর, তাও আবার হয় নাকি! আর যদি তাও হয় তাহলে সোয়েটার তো ওই লোকটার কোনও কাজেই লাগবে না। তাহলে সে নিজে গিয়ে পরিয়ে দেবে নাকি? কিন্তু হঠাৎ যদি মারতে আসে? পাগলকে বিশ্বাস নেই। তাছাড়া ওর কাছে যাওয়ার অন্য সমস্যা আছে।কাছে গেলেই গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে। অবশ্য একটা কাজ করা যায়। রুণু সোয়েটার খুঁজে রাখলে দূর থেকে ছুঁড়ে দেওয়া যেতে পারে। কয়েকদিন এইসব ভাবতে ভাবে এক সময় পাগলের অস্তিত্বটা ভুলেই গিয়েছিল। রোজ দেখত ঠিকই কিন্তু আলাদা কোনো ভাবনা জন্ম নিত না।
আজ রুম্পার কথা শুনে মনে হোলো সত্যিই তো অন্যায় হয়েছে। মেয়েকে বললো, "সত্যি ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার একটা পুরানো সোয়েটার ওকে দিলে কেমন হয় মামনি?"
"খুব ভালো হয় বাপি। তাহলে এখনই দিয়ে দাও বেচারিকে। দেখবে ঈশ্বর খুশি হয়ে তোমাকে বর দেবে।"
"তাই নাকি!"
“হ্যাঁ,আমাদের স্কুলের ম্যাম্ বলেছেন। আর্ত মানুষদের সেবা করলে ঈশ্বর খুশি হন।"
"তাহলে তো দিতেই হয়। কিন্তু তোমার মামনি কি এখন একটা সোয়েটার খুঁজে দেবে?"
বলে সে আড় চোখে রণিতার দিকে তাকায়।
"সোয়েটার খুঁজে রেখেছি সে প্রায় পনেরদিন আগে। তোমারই তো আর মনে ছিল না।"
অপ্রস্তুত ভাব কাটাতে সমীরণ বলে, 'ঠিক আছে বের করে দাও এখনি দিয়ে আসছি।"
রুম্পা তাল দেয়,"দাও না, মা এক্ষুণি দাও।"
রণিতা শোবার ঘরে যায়।
"ঐ তো কাগজ কাকু আসছে।"
বলতে বলতে রুম্পা বারান্দায় ছুটে যায়। সমীরণ দেখে কাগজওয়ালা ছেলেটা বর্ষাতি দিয়ে সাইকেলে রাখা কাগজগুলো ভালো করে ঢেকে নিজে ভিজতে ভিজতে আসছে। রুম্পা তার হাতে কাগজ এনে দেয়। কাগজে তাজা ভাবটা আর নেই। বর্ষাতি গায়ে জড়িয়ে ভেজেনি যদিও, তবে নেতিয়ে গেছে।হেডলাইন দেখে তার মনটা অবশ্য তাজা হয়। হেডলাইন বলছে,'নিম্নচাপের ভ্রুকুটি, দক্ষিণবঙ্গে ভারীবর্ষণের পূর্বাভাষ।' তাহলে ছুটিটা বোধ হয় লেগেই গেলো।
রুম্পা আবার দৌড়ে আসে। “এই নাও বাপি সোয়েটার। যাও শিগ্গির ওকে দিয়ে এসো। সমীরণ ভালো করে গুছিয়ে বসে নিম্নচাপের খবরটা জমিয়ে পড়বে বলে। রুম্পা তাড়া দেয়, “যাও না বাপি দিয়ে এসো।"
“দাঁড়া অত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন?" হেডলাইনটা দেখে নিই। এই বৃষ্টিতে বেরোলে ভিজে যাবো তো। তাছাড়া খাবার কিনতে বাজারে তো যেতেই হবে। একটা ভ্যানরিক্সা আসুক।তখন সোয়েটারটা দিয়ে ভ্যানে করে একেবারে বাজার ঘুরে আসবো।'
বলতে বলতে সে খবরের মধ্যে ডুবে যায়। খনিক পরে রুম্পা আবার তাড়া দেয়।
"ঐ দেখো বাবা একটা ভ্যান। এবার যাও।"
বাধ্য হয়ে কাগজ গোটায় সে। রাস্তার দিকে তাকায়। একটা ভ্যানওয়ালা রাস্তার ধারে ভ্যান দাঁড় করিয়েছে। এই বৃষ্টিতেও বেরিয়েছে!অবশ্য আজই তো বেরোবার দিন | দশ টাকা ভাড়া আজ বিশ টাকা হবে। আজ দাঁও মারার দিন। কিন্তু ভানওয়ালাটা এ দিকেই আসছে কেন! সে আগ্রহী হয়।
ছাতা মাথায় ভ্যানওয়ালা এগিয়ে আসে। তার হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ। লোকটা সোজা চণ্ডিমণ্ডপে ওঠে। ছাতাটা এক পাশে নামায়। তাহলে বোধহয় বৃষ্টিতে মাথা বাঁচানোর জন্যই এখানে দাঁড়ালো। সমীরণ ভাবে। কিন্তু তাকে অবাক করে লোকটা এগিয়ে যায় পাগলটার দিকে। ইশারায় তাকে উঠে দাঁড়াতে বলে। পাগলটা দাঁড়ায়। এবার দুপাশে দুহাত ছড়িয়ে দিতে বলে। তাই করে পাগলটা। লোকটা তার পলিথিনের ব্যাগ থেকে একটা আলখাল্লা জাতীয় ঢোলা পোশাক বের করে। সমীরণ দু-চোখে বিস্ময় নিয়ে দেখে লোকটা খুব যত্ন করে পাগলটাকে পরিয়ে দিল ওটা। অনেকটা হাউস কোটের মতো দেখতে পোশাকটা। কোমরের কাছে একটা কাপড়ের বেল্ট। সেটাও বেঁধে দেয় । পোশাকের অনেক জায়গায় তাপ্তি মারা। হয়তো বা কারো কাছ থেকে চেয়ে এনেছে। তারপর আর কোনদিকে তাকায় না লোকটা।
ছাতা হাতে মণ্ডপ থেকে নেমে যায়। রুম্পা হাততালি দিয়ে ওঠে।
পাগলটা তখনো দুহাত ছড়িয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। ঘাড়টা একদিকে কাত করে মিটিমিটি হাসছে। অথচ ভ্যানওয়ালা ফিরেও তাকায় না। এই সব দৃশ্যপটকে পিছনে রেখে, তুমুল বৃষ্টিতে উদাসীন মানুষটা হেঁটে যায় সামনের দিকে। স্থিরচিত্রের মতো জানলার ফ্রেমে লগ্ন হয়ে থাকে সমীরণ।
————————
————————————